দেশজুড়ে বিজেপি-আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি-রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তার হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস-বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ প্রথম কিস্তি ।
ভারতীয় সংবাদ ও গণমাধ্যম তাদের কারখানায় এক দেশ , এক নেতার মূর্তি নির্মাণে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে । পাকিস্থান, বালাকোট , সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ,জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ , ‘ ডি‘ ভোটার অতএব সন্দেহজনক , তিন তালাকের ফৌজদারীকরণ, গোরক্ষার ছদ্মবেশী আহ্বান , রামমন্দির নির্মাণ সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এক জমজমাট সান্ধ্যকালীন পরিবেশ ! গুজরাট , গোধরা কান্ড এখন সব অতীত । গান্ধী নয় , গডসে! গান্ধী হত্যাকারীর নামে সাধন পূজন, মন্দির নির্মাণ । বহুত্ববাদ , ধর্মনিরপেক্ষতা , গণতন্ত্র , সমাজতন্ত্র- সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ বিষয়গুলি নয় , আরএসএস-বিজেপি-এর গবেষণাগারে নির্মিত ‘ হিন্দি, হিন্দু , হিন্দুত্বকে ‘ ভিত্তি করে তারা নতুন ভারত নির্মাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে । আরএসএস-বিজেপি-এর যুগলবন্দীর এই সরকার দ্বিতীয় পর্বে ক্ষমতাসীন হওয়ামাত্রই তাদের যাবতীয় এজেন্ডাকে রূপদান করে চলেছে । ছন্নছাড়া বিরোধী দল এবং নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের অভাব সাময়িকভাবে হলেও এক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হয়েছে । শত শহীদের রক্ত, বলিদান কি তবে ব্যর্থ হয়ে যাবে ? মহাত্মা গান্ধী , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহেরু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ , নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কী আজ এই সংকীর্ণ , অসহিষ্ণু , কল্পিত জাতীয়তাবাদ ,ধর্মনিরপেক্ষ বাতাবরণ বিনাশকারী শক্তির বিরুদ্ধে চুপ করে থাকতেন ?
অন্ন ,বস্ত্র , বাসস্থান , কর্মসংস্থান নয় , কল্পিত রাষ্ট্রবাদ-এর গাথা-উপগাথা তৈরি করে এই শক্তি মানুষকে ভোলাতে চাইছে এবং সফল হয়েছে । ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন তার সবথেকে বড়ো প্রমাণ । আবার এও সত্য যে , বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সাজানো , বানানো ,চটকদারিরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে । তার কারণ, প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন মোড়কে এই ভাবনাকে হাজির করতে হয় । কর্মহীন , ভূখা মানুষকে তাই আজ আর ‘ মন কি বাত ‘- আর্কষণ করে না । আর কে না জানে , গণতন্ত্রে সাধারন মানুষই শেষ কথা বলে । মানুষই ইতিহাস রচনা করে । গরিব , কৃষক , শ্রমিক , মেহনতি মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে তাই আজ পথে-ঘাটে । সীমাহীন বেকারত্ব , বেহাল কৃষিব্যবস্থা , কৃষকের দূরাবস্থা, শিল্পহীন শ্রমিক , একের এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া , পিএমসির মতো ব্যাঙ্ক দেউলিয়াকরণ, কালো টাকা উদ্ধারের নামে নোটবন্দী, জিএসটি- এক কথায় সাধারন মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা ! কিন্ত শাসককূল আত্ম-অহংকারে ভুলে যায় ‘ সকল সুখেরই সীমা আছে ‘।
২০১৯ –এর লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রী রাহুল গান্ধীর প্রচারে এই সমস্ত বিষয়গুলিই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল কিন্ত সেই সময় দেশের মানুষের তা সমর্থন পায়নি । কংগ্রেস সভাপতি উচ্চারিত ‘ ন্যায় ‘ প্রকল্পের বানী মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে মানুষকে তাই আজ নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে । এই নির্বাচনী প্রচারেও তিনি ‘ ন্যায় ‘ প্রকল্প ও দেশের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার ছবি সাধারন মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন । সম্যকভাবে হলেও দেশের সাধারন মানুষ তাঁর উচ্চারিত কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাচ্ছেন । বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধীর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহজাত দক্ষতা । এই সব কিছুরই প্রতিফলন হরিয়ানা , মহারাষ্ট্র এবং বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনের ফলাফলে। এই ফলাফলে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষ এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করছেন ।
সীমা অসীমকে কখনোই ছাড়িয়ে যাবে না । যায়ও নি । মাত্র পাঁচ মাস পূর্বের নির্বাচনী ফলের সঙ্গে মহারাষ্ট্র হরিয়ানা ও ৫১টি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলের তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই বিষয়টির সত্যতা প্রমাণিত হবে । দেশব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষ ,গণতান্ত্রিক শক্তির সামগ্রিক ঐক্যের অভাব , প্রচারের জোয়ারে আস্থাহীনতা সত্ত্বেও জাতীয় কংগ্রেস সহ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির নেতা-কর্মী সর্বোপরি ভুক্তভোগী সাধারন মানুষ আরএসএস –বিজেপি-এর বিরুদ্ধে আপন জয়গাথা রচনা করেছে। মনে রাখতে হবে , এই শক্তি সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়নি। হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাই আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই । রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে এই শক্তি বাসা বাঁধতে সমর্থ হয়েছে । ৬০ লক্ষেরও অধিক ‘ রাজনৈতিক হিন্দুত্বে’র বাহিনী , ‘ হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ অফুরন্ত টাকার জোগান – এই ধরনের একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সেই শক্তিকে জানতে ও বুঝতে হবে । এই শক্তির সামগ্রিক রূপ সন্ধান ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নও আজকের প্রেক্ষিতে খুব জরুরি হয়ে পড়েছে । কেননা , এর সঙ্গে বহুত্ববাদ ধর্মনিরপেক্ষ , গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামো এবং অতি অবশ্যই এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানুষের জান-মাল-ঈমানের নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে । একুশ শতকীয় ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় বিষয়টি বড়ো আকারে হাজির হয়েছে । স্বভাবতই, নির্বাচনী জয়-পরাজয় এখন শুধুমাত্র একটি দলের সাফল্য-ব্যর্থতা , অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক উন্নয়নের প্রশ্নে আর সীমিত থাকছে না । গণতন্ত্রে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থপনায় এক দল হারবে , এক দল জিতবে , এতে নতুনত্বের কিছু নেই । আর তা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ-ও বটে । কিন্ত তা আর থাকছে কোথায় ? তথাকথিত ‘ রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী দেশভক্ত ‘বৃন্দ সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার –এর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের দোহাই দিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলিয়ে দেওয়ার অবিরাম লীলাকীর্তন সগর্বে চালিয়ে যাচ্ছে । সংখ্যালঘুরা দাঁড়িয়ে রয়েছে জীবন –মরনের মাঝে , অস্তিত্বের প্রশ্নে , অবিশ্বাসী বাতাবরন , অসহায়তা যেন আর পিছু ছাড়তে চায় না ।