প্রায় তিনশো বছরের বড়শুলের দে পরিবারের দুর্গা হরগৌরী রুপে পূজিত হয়

Paramanik Akash
আজ থেকে প্রায় পৌনে তিনশো বছর আগের কথা। তখন বড়শূলে জমিদারীর প্রতাপ ছিল। লোক লস্কর নিয়ে গমগম করতো দে পরিবার। নদী পথে চলত বাণিজ্য। জানা যায়, এমনি বাণিজ্য করতে আসা ব্যাপারীদের ইচ্ছায় জমিদার দে পরিবারের শুরু হয়েছিল মূর্তি পুজার প্রচলন। যদিও তার আগে ঘটে পটে দুর্গা পুজার রীতি ছিল এই পরিবারে। বাড়ির মহিলাদের জন্য ছিল পূজোর আচার অনুষ্ঠানে বিধি নিষেধ। অর্থাৎ পর্দানসীন বিষয়। পর্দার পিছন থেকেই তাঁরা দে পরিবারের দুর্গাপুজো দেখতেন।আজ জমিদারি নেই, এখন কালের নিয়মে সে সবই অতীত। বর্তমানে ভগ্নপ্রায় পুজো দালানের মহিলা অন্দরমহল। তবে সেকালের পুজোর বৈভব থাকলেও, আজও আচার অনুষ্ঠান বা প্রথা মেনে পুজো হয় দে পরিবারে।
১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বর্ধমানের বড়শুলের দে-পরিবারে দেবী হরগৌরী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। বড়শুলের জমিদার দে-পরিবারের বর্তমান এস্টেট ম্যানেজার তথা সেবাইত দীপক কুমার দে জানিয়েছেন, ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের আগে ঘটেই দেবীর আরাধনা হত। কিন্তু ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে তত্কালীন জমিদারকে দেবী স্বপ্নাদেশ দেন। আর তারপরেই ঘট ছেড়ে মূর্তি পূজোর প্রচলন হয়। কিন্তু এই মূর্তি পুজো নিয়েই দে পরিবারে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েই এই হরগৌরী মূর্তি তৈরী করে তার পূজো শুরু হয়। আবার কেউ বলেন, কুলগুরুর অনুমতি নিয়ে কয়েকটি মূর্তি সম্বলিত চিত্র তৈরী করা হয়। তা রাখা হয় একটি পাত্রে। এরপর পরিবারেরই একটি কুমারী মেয়ের চোখ বেঁধে তাকে লটারীর মত করে একটি মূর্তি তুলতে বলা হয়। আর মেয়েটি বহুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর এই হরগৌরী মূর্তিই তুলে তা গৃহকর্তার হাতে তুলে দেন। কেউ কেউ আবার সেই সময় দে পরিবারের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আসা ব্যাপারীদের উদ্যোগেই এই হরগৌরী মূর্তি পুজো প্রচলনের কথা বলে থাকেন।তবে যাইহোক, সেই থেকেই হরগৌরী মূর্তিরই পুজো হয়ে আসছে বড়শূলের দে পরিবারে।
বড়শুলের এই দে পরিবারের দুর্গা দালানটি গ্রীক ও বৃটিশ স্থাপত্যরীতি অনুসারে নির্মিত। পূজা মণ্ডপ তিনটি ভাগে বিভক্ত। পূজো মণ্ডপের মধ্যে বিশালাকার থামের ফাঁকে একচালায়, বড়পাটায় এক উচ্চ আসনে বাঘ ছাল পরিহিত বিশালাকার শিবের বাম উরুতে পরম আদরে বসে আছেন হরজায়া দেবী দুর্গা।এখানে দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী দশভুজা নন, তিনি দ্বিভূজা, শিবসোহাগিনী গৌরী।মহাদেবের এক হাতে আছে ডমরু আর অন্য হাতে আছে সিঙ্গা, মাথায় আছে জটা,জটার ওপর একটি সাপ এবং দুই কাঁধে দুটি সাপ।এখানে মা দুর্গার বাহন সিংহ নেই। নেই অসুরও।আছে শিবের পায়ের নীচে মোষ। দেবীর সপারিষদ দলে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী থাকলেও লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর কোনো বাহন নেই।
দীপক কুমার দে জানিয়েছেন, দে পরিবার বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় পুষ্ট হলেও দুর্গাপুজো হয় তৎকালীন কুলগুরুর নির্দেশে শাক্ত মতেই। দে পরিবারের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। বলিদানের সময় রাজরাজেশ্বরের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলিদান দেখেন না। দুর্গাপুজোর প্রথা অনুসারে বলি দেওয়া ছাগের মুণ্ড দেওয়া হয় কর্মকারকে বা বলিপ্রদানকারীকে। ধড় দেওয়া হয় কুলপুরোহিতকে। 
পুরনো রীতি মেনেই দেবীর সিঁদুর খেলার সময় কোনো 
পুরুষকে আজও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না পুজো দালানে। দশমীর দিন সকালে দে পরিবারের সদস্যরা শুচিবস্ত্র পরে বেলপাতায় ১০৮ বার দুর্গা নাম লিখে তা দেবীর চরণে রেখে দেন। বিসর্জনের প্রথাও চলে আসছে একইভাবে। দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে প্রায় ৩০ জন আদিবাসী মানুষ গ্রামের রাস্তা ধরে নির্দিষ্ট জলাশয়ে বিসর্জন করতে যায়।


Find Out More:

Related Articles: